১।
রাস্তা পাড় হতেই পুলিশ হুইসাল দিল। “থাম! থাম!”
সেলিম এসব ভয় পায় না।
“কি হইসে ভাই?”
“এতো রাতে তুই কোথায় যাস?”
“ভাই তুই তোকারী করেন কেন। আমি কাপড়ের ব্যবসা করি। নরসিন্ধি থেকে আসতে পথে বাস নষ্ট হইসে এজন্য এতো দেরী।”
পুলিশটা ওর মুখে টর্চ মারলো তারপর ঘুড়িয়ে ওর ব্যাগের উপর আলো ফেলে বলল, “খোল দেখি!”
শাবলটা পিঠের সাথে লম্বা লম্বি বাঁধা। ইচ্ছা করলে একটানে বের করে পুলিশের মাথায় একটা বারি মারতে পারে!
ব্যাগের চ্যেনটা খুলে দিল। পুলিশ ব্যাগের ভিতর হাত চালান করে দিয়ে এদিক ওদিক খুজলো। না কাপড় ছাড়া কিছু নেই!
“এই সব কিসের কাপড়?”
“কাফনের। খুব ভাল কাপড়, পিওর সুতি!
নেবেন নাকি ভাই?”
পুলিশটা তাড়াতাড়ি করে হাত সড়িয়ে নিলো। “দোকানে সাপ্লাই দাও?”
“জ্বী। দোকানে তো অনেক দাম! আমি ষাট টাকা গজ বিক্রী করি। কিনে রাখতে পারেন। এই জিনিষ তো আজ হোক কাল হোক লাগবেই।”
পুলিশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা শিরশিরে অনুভূতি নাড়া দিয়ে গেল।
“যাও যাও মিঞা তাড়াতাড়ি যাও” পুলিশটা ধমকে উঠলেও সে যে ভয় পেয়েছে তা বোঝা গেল। ব্যাগটা ছেড়ে দিয়েছে।
“আরে রাগেন কেন? আপনার জন্য তো বলি নাই। বুড়ি বাবা মা আছে না, শ্বশুড় শ্বাশুড়ি!”
আজকে ডিউটিতে আসার সময় দেখে এসেছে মেয়েটার অনেক জ্বর। এসব অকথা কুকথা শুনলে মন কেমন করে!
“যাও, যাও! তোমার এসব কু কথা শোনার সময় আমার নাই।”
সেলিম চেন বন্ধ করে হাটতে লাগল। “চল উড় যা রে পানছি, দেশ হুয়া বেগানা..”
রাতের নিস্তব্ধতায় তার গান নিজের কাছে বেশ সুরেলা লাগতো থাকে।
২
সেলিম সকাল দশটায় দোকানটার কাছে দাঁড়ায়। দোকানটার নামটা অদ্ভুত-গুড বাই স্টোর।
এসব দোকানের নাম সাধারনত হয় চির বিদায় স্টোর, শেষ বিদায় স্টোর এরকম। কিন্তু তা না হয়ে এমন হবার একটা কারন আছে।
গুড বাই স্টোরে শুধু কাফনের কাপড়, চা পাতা, সাইজ করা বাঁশই পাওয়া যায় না, হিন্দুদের শেষকৃত্যের ঘি, লাকড়ী,চন্দন, ধূপ কাঠ থেকে খৃস্টানদের কফিন বাক্সও পাওয়া যায়। অবশ্য এটা ভাড়ায়! এছাড়া কর্পুর, আগরবাতি আর সাদা থান কাপড়। এ কাপড় সবচেয়ে বেশী লাগে! মুসলমানের লাগে, খৃষ্টানের লাগে হিন্দুরও কখনও লাগে।
গুড বাই শব্দটা ধর্মীয় সংকীর্নতার উর্দ্ধে উঠে একধরনের সর্বজনীনতার দিকে গেছে। অন্তত এ দোকানের মালিক ফরিদ মিঞা এটা ভাবেন।
তার দোকানে দুজন কর্মচারী, একজন ডেভিড একজন কৃষ্ণ। এরা দুজন রাতে পালা করে দোকানেই থাকে।
কাজেই রাত বিরাতেও এ দোকানের সার্ভিস পাওয়া যায়। সাইন বোর্ডে বড় করে একথা লেখা আছে। সাথে মোবাইল ফোন নম্বর।
এ নম্বরে ফোন এলেই বন্ধ দোকানের ঝাঁপ খুলে যায়।
যম যেমন সময় মানে না, তার পরবর্তি কার্যক্রমের তেমনই সময় মেনে হয় না।
এরা তিনজনই সব ধর্মের মৃত্যু পরবর্তি আচার সম্বন্ধে এত ভাল জানে যে, কেউ একজন থাকলেই হয়!
যথারীতি দোকানের ঝাঁপ ফেলানো। এগারোটার আগে খোলে না। ফরিদ ফোন দিতেই কৃষ্ণ ঝাপ অর্ধেকটা খুলল। সকাল এগারোটা থেকে রাত এগারোটা দোকান খোলা। বাকি সময় অনুরোধে।
সময়ের আগে পরে এটাই নিয়োম, ঝাঁপ পুরোটা খোলে না।
ফরিদ ঢোকার পর আবার ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়।
৩৫ সেট কাফনের কাপড় বুঝে নিয়ে তুলে রাখে। ধবধবে সাদা লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রী মেরে রাখা।
গত মাসের পাওনা তের হাজার টাকা! প্রতিবার মাল দিয়ে আগের বারেরটার বিল নিয়ে যায়। টাকা চাইতেই কৃষ্ণ বলে, বসেন। সাড়ে দশটায় মালিক আসবে। আপনার সাথে কথা আছে।
খুব মেজাজ খারাপ হয়। কথার কি আছে! পাঁচ বছর ধরে এ দোকানে সাপ্লাই দেয়। মাল দেয় টাকা নেয়। এমন না যে এ মাল পড়ে থাকে!
ভেবে পায় না সেলিম!
আরও কত দোকান আছে, চাইলে নগদ দিয়ে মাল নেবে।
এক কাপ চা এনে দেয় কৃষ্ণ। “চা খান!”
“কি হইসে? কও না। কোন সমস্যা? তুমি তো জানো!”
“আমি ভাল করে জানি না।”
“যা জান তাই কও।”
“মালিক আসুক না! সেই বলবে” একটা গ্লুকোজ বিস্কিটের বাক্স খুলে কয়েকটা বিস্কিট ছড়িয়ে দেয়!
সেলিম চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে ভাবতে থাকে কি হতে পারে!
ওর কাজ তো ঝড়নার পানির মত। স্বচ্ছ, পরিস্কার!
৩
বাড়ি ফিরে টেবিলের উপর আবার কাপড়টা মেলে ধরলো। ফরিদ মিঞাও দোকানে খুলো দেখিয়েছে!
কি যে লজ্জার কথা! কোন দিন এমন হয় নাই।
আজ অনেক কথা শুনিয়েছে! পাওনা টাকা নিয়ে কখনও ঘোরায় না কিন্তু আজ সে টাকাটা দেয় নি। তার এতো বছরের ব্যবসায় নাকি সেলিমের কারনে কালির দাগ লাগলো!
কত কম দামে যে পায়, আর বসে বসে ব্যাবসা করে! সব ঝামেলা তো চায় সেলিমের উপর দিয়ে। এটুকু ভুল তো হতেই পারে।
খালি লাভ নিবা- এটা তো হতে পারে না। সেলিম মনে মনেই গালি দেয়!
আবার নিজেকেও দোষারোপ করে,কাপড়ের এক পাশে স্পষ্ট রক্তের দাগ! এমন ততো থাকার কথা না!
সে নিজের হাতে প্রথমবার ধোয় তারপর লন্ড্রিতে পাঠিয়ে আয়রন করিয়ে আনে।
তার ভুল হতে পারে কিন্তু লন্ড্রির লোকরা তো রক্ত দেখলে আরকবার ধুয়ে নেবে এমনই তো কথা! তারাও দেখল না!
না লন্ড্রিতে যেতে হবে! খোঁজ নিতে হবে। একা ও কেন দায় নেবে।
রহীমা বিবি ঠিকই ধরে ফেলে, কিছু গন্ডোগোল হয়েছে।। মানুষটা কোন কিছু নিয়ে পেরেশন। সাত বছর ধরে ঘর করে, কখনও মানুষটাকে এতো চিন্তিত হতে দেখে নি।
এমনিতেও ওর এমন শান্ত ধীরস্থির মানুষ আর দেখে নি! নিজের কাজ নিয়ে থাকে। কোন গ্যান্জামে যায় না।
“আপনারে চিন্তিত দেখায়!”
“কিসের চিন্তা! পরিশ্রম করি, হালাল রোজগার করে আমার কিসের চিন্তা!
যা, যা তুই আজকে একটু টক বেগুন রান্না কর! ঐ দিনের মত যেন হয়। খুব ভাল হইসিল।”
ওদের ছেলে মেয়ে নাই। বিয়ের দুই বছরের মাথায় ডাক্তার দেখিয়েসে। ডাক্তার কোন সমস্যা পায় নাই।
রহিমা বিবি এটা নিয়ে চিন্তা করে না। আল্লাহ যখন দেওয়ার দিবেন। এত ভাল একটা মানুষের সিলসিলা থাকবে না তা তো হয় না!
দরজায় ধুপ ধাপ শব্দ শোনা যায়। কলিং বেল থাকতে বেল না বাজিয়ে দরজা বাইরায় কে! সেলিমের রাগ উঠে যায়!
“কে? কে?” সেলিম দরজা খোলে! কয়েকজন পুলিশ দাড়িয়ে আছে।
“সেলিম কে?”
“আমি! কেন?”
“থানায় চল দরকার আছে!”
“আমাকে থানার কি দরকার?” সেলিম ঘাবড়ায় না।
“এতো কথার জবাব দিতে পারবো না। ওসি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিস। তিনি তোর জন্য বসে আছেন!”
“তুই তোকারি করেন ক্যান..”
“চোপ কর! চল!”
“কাপড়টা বদলায় আসি!”
এসময় রহীমা বিবি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে!”কি হইসে?”
“কি হইবো! পুলিশ আসছে আমার সাথে নাকি ওসি সাব কথা বলতে চায়। শুনে আসি।
আমি হালাল রুজি করে খাই। আমারে ডাকবে ক্যান! নিশ্চয়ই কোন ভুল হইসে।
আমার সার্টটা এনে দে আর মানি ব্যাগটা দিস!”
৪
থানায় বদরুলের সাথে দেখা হলো। বদরুল বনানী কবরস্থানের গোরখোদক। অনেক দিনের পরিচিত। চেহাড়াটা খুব মলিন দেখাচ্ছে! মুখটা ফোলা ফোলা!
সেলিম চোখ দিয়ে ইশারা করে ব্যাপরটা বুঝতে চায়।কিন্তু বদরুল মুখ নামিয়ে বসে আছে। মুখে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও সেলিম থেমে যায়। কয়েকজন পুলিশ বসে আছে।
একটা পুলিশ উঠে এসে ওর দিকে তাকায়। “তোরে তো চেনা চেনা লাগে!”
“তুই তোকারী করেন ক্যান?”
“আরে হারামজাদা! এই তো মনে পড়ছে! রাতে টহল দেয়ার সময় কালইতো তোরে থামাইসিলাম। ফাপড় দিয়ে চলে গেলি।”
হয়ত আরও কিছু বলতো। এসময় আরেকটা পুলিশ এসে ওকে বলল, “ভিতরে চল। ওসি সাহেব বসে আছে।”
দরজা দিয়ে উকি দিতেই ওসি হাতের ইশারায় ডাকলো, “আসো সেলিম ভিতরে আসো।”
লোকটাকে খারাপ লোক মনে হল না। ফরসা, তেলচুকচুকে চেহাড়া!
“স্যার আপনাদের কোথায় ভুল হইসে। আমি সাধারন মানুষ। টুকটাক ব্যাবসা করি হালাল রুজি খাই..”
ওসি হাসলেন। “তা সেলিম, কিসের যেন ব্যবসা করো?”
“নরসিন্দিথেকে থান কাপড় এনে দোকানে সাপ্লাই দেই!”
“শাড়ি কাপড়? কোন দোকানে সাপ্লাই দাও?”
“শাড়ি না কাফনের কাপড়! চির বিদায় স্টোর, গুডবাই সপ..”
তা নরসিন্দির কোন দোকান থেকে আনো?”
“বিশ্বাস থান বিতান!”
ওসি সাহেব হাসেন। “তুমি তো খুব গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারো!”
পাশে দাড়ানো পুলিশকে বলেন,”আগের টাকে আনো তো।”
বদরুল এসে দাড়ায়।
“কি বদরুল, ওরে চিনো?”
বদরুল মাথা ঝাকায়।
“কি সেলিম মিঞা তুমি ওরে চিনো?”
“কাফনের কাপড় বিক্রী করি, ও কবর খোড়ে! পরিচয় আছে!”
” হা, হা, হা! সাবাস। শুধুই পরিচয়! ”
“কি বদরুল কবর থেকে কাফনের কাপড় চুরি করতো কে?”
কেউ কোন কথা বলে না।
ওসি সাহেব এবার গর্জন করে উঠলেন। “কথা কস না কেন! মরা মানুষরেও তোরা শান্তিতে থাকতে দিবি না!”
সেলিমের এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা আছে। মাটির নীচে আর মানুষের কি আব্রুর দরকার! হাসরের ময়দানে তো সবাই কাপড় ছাড়াই বিচারের জন্য,দাঁড়াবে!
একবার কবর হয়ে গেলে তারপর তো দেহটাও মূল্যহীন! এ কাপড়টাও।
কিন্তু কিছু বলল না। পুলিশের সামনে যত কথা কম বলে পারা যায়!
৫
সেলিমের ফাসির আদেশ হলো। ডাকাতি এবং হত্যা। কোন অজানা কারনে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বিচার কার্যশেষ হলো।
একজন বড় কর্মকর্তার ছেলের বৌ ছুড়িকাহত হয়ে নিহত হয়েছিল। দাফনের ছয় ঘন্টা পর তার মৃতদেহ তুলে পুন: ময়না তদন্ত করা হয়। সেলিমের কাছে পাওয়া চাদরে যে রক্তের দাগ ছিল তা সে নিহত মেয়ের বলে ফরেনসিক ল্যাব জানায়।
সেই পুলিশ সাক্ষী দেয় ডাকাতি করে পালানোর সময় সে রক্তাক্ত কাপড় আর শাবল নহ সেই প্রথম তাকে আটক করে! এ জন্য তার ভাগ্য বিভাগীয় পুরস্কার জোটে!
কর্মকর্তা ওসি সাহেবকে ফোন করে ধন্যবাদ দেন ব্যাপরটা সুন্দর ভাবে ট্যাকেল দেয়ার জন্য। সামনে তার প্রমোশনে এটা একটা বিশেষ যোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হবে।
সেই কর্মকর্তা হৃদয়হীন ছিলেন না। রহিমা বিবির সাথে দেখা করে বলেন,
“মা সবই কপালের ফের। চিন্তা করো না এখন থেকে তোমার সব ভার আমার। পরিচিত এক বন্ধুর গার্মেন্টসে তোমার চাকরীর ব্যাবস্থা করে দেবো।”
এই ছেলেকে নিয়ে জীবনে কম ঝামেলায় পড়েন নি! পছন্দ না হয় ডিভোর্স দে, গা হাত তোলার কি দরকার! একেবারে খুনোখুনি!
ঠিক করে ফেলেছেন ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন!
রহীমা বিবি টক বেগুন আর ভাত রান্না করে এনেছে।
সেলিমের হাতে ডান্ডাবেরি পরানো। ওর সাথে যে পুলিশ ছিল তাদের সাথে বেশ খাতির হয়ে গেছে। তারা একটা হাত খুলে দিতে চাইল। সেলিম নিষেধ করলো।
“রহীমা তুই খাওয়ায় দে!”রহীমা এক হাতে চোখ মোছে আর এক হাত দিয়ে নলা করে ওর মুখে ভাত দেয়!
“সত্যি করে বলেন আপনি কি আসলেই খুন করসেন!”
“এখন এসব সত্যি মিথ্যার কোন দাম নাই। যে যেইঅপরাধ করে সে কি সব সময় সে অপরাধের শাস্তি পায়! সবলের শাস্তি হয় না। শাস্তি হয় দূর্বলের।
তোর কি হবে তা নিয়ে দুঃখ পাই”
রহীমা কিছু বলতে চায় কান্নার কারনে বলতে পারে না।
৬
ফাসীর পর জুরাইন কবরস্হানের অস্থায়ী কবরে সেলিমের দাফন হয়েছে।
রহীমা বিবি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখলো। চাকরীর তার দরকার নেই। কাল সকালেই বাপের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ চলে যাবে। এই শহরে একা থাকা যায় না।
সন্ধ্যার অন্ধকারটা গাঢ় হচ্ছে। রহীমা কিছক্ষন পর পর ফুপিয়ে কাঁদে আবার থামে।
পাশের বাড়ির বজলু ভাবী ওর সাথে ছিল। সেই তাড়া দিল। “চলেন এবার যাই।”
ইচ্ছা করে না তবু রহীমা বজলু ভাবীর পিছন পিছন চলতে থাকে।
নতুন লাশের খবর চলে গেল। হাফিজ চারপাশটা ভালমত দেখে শাবলটা ঘারের কাছে লুকিয়ে নেয়। বউ কে বলে, “ভাল করে দরজা বন্ধ কর।আমার রাত ডিউটি, আসতে দেরী হবে।”
ঘটনা বা দূর্ঘটনার পূনরাবর্ত্তি ঘটতে থাকে!